ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

সোনালী সেই দিনগুলো (দ্বিতীয় পর্ব)

ফেরদৌস সালাম

প্রকাশ: ১৫:৪৩, ৪ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৩:৩২, ৫ মে ২০২৫

সোনালী সেই দিনগুলো (দ্বিতীয় পর্ব)

১৯৮৩ সালের নভেম্বরে সোনালী ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে ময়মনসিংহ প্রিন্সিপাল অফিসে চূড়ান্ত নিয়োগের চিঠি পেলাম। দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়ায় ভালো লাগল ।

আব্বা বললেন, “তুমি এখন আর ছাত্র নও। ছাত্ররাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে।” আমি তখন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ২১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলন প্রস্তুতি বিষয়ক কমিটির সদস্য ও টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য হিসেবে আমাকে ঢাকা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। যাহোক। আমি ময়মনসিংহ প্রিন্সিপাল অফিসে যোগদানপত্র জমা দিলাম। সেখানেই পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র টাঙ্গাইলের রেজাউল করিম খানকে। সেও ছাত্রদলের কর্মী ছিল। সে আমাকে দেখে সহাস্যে বললো, ‘কী ব্যাপার? সবাই ব্যাংকে চলে এলে নেতার কাজ করবে কারা?”  

বলে নেওয়া ভালো ছাত্র রাজনীতি করার সময় অধ্যাপক ফেরদৌস হোসেন, কুমিল্লার বিশিষ্ট আইনজীবী ও  সমাজসেবক সামসুল আলম মজুমদার মোহন , সাবেক সরকার প্রধানের প্রধান প্রেস সচিব শামীম চৌধুরী, শিক্ষা বিভাগের বিশিষ্ট কর্মকর্তা রফিকসহ অসংখ্য নক্ষত্রের সমাবেশে আমি ছিলাম খুবই ম্রিয়মান। একদিকে সাংবাদিকতা অন্যদিকে সক্রিয়ভাবে  ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছিলাম বলে নিয়মিত ক্লাস করতে পারিনি। তাই ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সঙ্গেও দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। স্বাভাবিকভাবেই শুধু টাঙ্গাইল জেলার পরিচিতরাই নয়, অন্য জেলার পরিচিতদের জন্যও দু-একটা তদবির করতে হয়। সাহস করে একবার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে অনুরোধ নিয়ে যাই। তখন ধানমনণ্ডি ২৭ নম্বরে ছিল বিএনপি'র কেন্দ্রীয় অফিস। তিনি আমাকে দেখেই বললেন, “কী? টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতা? কী জন্য?”

মনটা সেদিন সত্যিই প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল যে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আমাকে চিনতে পেরেছেন। বিষয়টি ছিল মানবিক। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য। তিনি আবেদনের ওপর লিখে দিলেন, তদন্ত সাপেক্ষে প্রসেস করুন। জিয়া।

আজও সেই ঘটনাটি স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। এ নিয়ে বিস্তারিত পরে আলোচনা করব। যাহোক এবার মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক।

ময়মনসিংহ প্রিন্সিপাল অফিসের প্রধান ছিলেন ডিজিএম সামসুল হক। তার চেম্বারে গেলে তিনি বসতে বললেন। আমার জেলার কথা জিজ্ঞেস করলেন। কোন বিষয়ে পড়েছি তাও জানতে চাইলেন। এক সময় বললেন, “আপনারা এ ব্যাংকের ভবিষ্যত। ভবিষ্যতে আপনারাই হবেন এ প্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি। তাই আপনাদের নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সকল কাজ শিখতে হবে।”

সেখানে চা খেলাম। তাকে যথার্থই অভিভাবক মনে হলো। অনুভব করলাম, তিনি একজন দক্ষ ব্যাংকার। তিনি বললেন, “আপনারা ভাগ্যবান। সরাসরি অফিসার/সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদানের সুযোগ পেয়েছেন।”

তিনি সংস্থান বিভাগের সিনিয়র অফিসার সিরাজুল ইসলাম সাহেবকে বললেন, “ওনাদের সহযোগিতা করুন।”

সিরাজ সাহেব বাইরে এসে বললেন, “আপনাদের মেডিক্যাল টেস্ট করাতে হবে।”

আরেকটি ফরম দিয়ে বললেন, “দুজন কর্মকর্তা পর্যায়ের গ্যারান্টার লাগবে।” 

মেডিক্যাল টেস্ট ওকে হলো।

আমার এক আত্মীয় তখন ময়মনসিংহ কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার। তার কাছে গেলাম। তিনি বললেন, “তুমি তো ব্যাংকে চাকরি করবে না। বিসিএস হলেই চলে যাবে। তখন ওরা আমাকে নোটিশ করবে । ঝামেলা করবে।”

যতই বললাম, “না আপনাকে কোনও সমস্যায় ফেলব না।” তাকে কোনোভাবেই রাজি করানো গেল না। ব্যর্থ মনোরথে ফিরতে হলো।

এ অবস্থায় যখন প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে ময়মনসিংহ শাখার সিঁড়িতে পা রাখছি। ঠিক ওই মুহুর্তে এক ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কোথায় কার কাছে যাবেন?”

জানালাম, আমি প্রবেশনারী অফিসার হিসেবে এ শাখায় নতুন যোগদান করেছি। পরবর্তী প্রশ্নে আমার বাড়ি টাঙ্গাইল শুনে তার কথা বলার আগ্রহ বেড়ে গেলো।

তিনি জানালেন, “আমার শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইল শহরে।”

বললাম, ওই বাসা আমাদের বাসার অনেক কাছে। এও বললাম, ওই বাসার ছেলেরা আমার খুব পরিচিত। এরপর চা খেতে খেতে বললেন, আপনার কোনও সমস্যা হলে জানাবেন।

আমি বললাম, “আপনি আমাদের বাসার পাশেই বিয়ে করেছেন।”

এরপর তিনি তার পরিচয় দিলেন। নাম আলমগীর। তিনি প্রিন্সিপাল অফিসে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত। টাঙ্গাইল করটিয়া সাদত কলেজের ছাত্র ছিলেন।

বললাম, “আপনি তো আমার বড় ভাই। আমাকে তুমি করে ডাকবেন।”

তিনি আমার হাতের ফরম দেখে বললেন, “কি? পূরণ করোনি?”

তাকে সবিস্তারে জানালাম, “পাইনি। টাঙ্গাইল গিয়ে নিয়ে আসতে হবে।”

তিনি ফরম নিয়ে নিজেই পূরণ করে স্বাক্ষর করে সংস্থাপন বিভাগে জমা দিয়ে বললেন, “সালাম আমার শ্যালক। জমা নিয়ে নেন।”

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবাক।

কৃতজ্ঞতা জানাতেই তিনি বললেন, “আরে তুমি তো আমার শালা। এখানে কৃতজ্ঞতার কী আছে?”

আলমগীর ভাই সেই থেকে আমার দুলাভাই হিসেবেই ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ সোনালী ব্যাংকের অফিসারদের নেতা ছিলেন। এরশাদ আমলে তিনি বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। আমাদের সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিস ভবনটি ছিল রওশান এরশাদের মায়ের। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শ্বাশুড়ির। আলমগীর ভাইয়ের সাথে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। এ ছাড়া তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ শহরের বাসিন্দা সাবেক ছাত্রনেতা। ব্যবহার ও আচার আচরণে ছিলেন অত্যন্ত ভদ্রলোক। সাহসীও ছিলেন। আমরা তার নেতৃত্বে ময়মনসিংহে অফিসার সমিতি গড়ে তুলি। আমাকে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশের দায়িত্ব দেয়া হয়।

উল্লেখ্য, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পারসোনাল ডিভিশন থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রথমে প্রিন্সিপাল অফিস/রিজিওনাল অফিসে প্রবেশনারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ঢাকা প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন শাখায়ও অনেকে নিয়োগ পান। আমি ইচ্ছে করলে ঢাকায় থাকতে পারতাম।  কিন্ত মনে হলো, এখনই বাইরে থাকার সময়। পরে আর ঢাকা থেকে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করবে না। এখন একা। জেলায় জেলায় ঘুরতে খারাপ লাগবে না। তখন আল্লাহর ইচ্ছায় সংসার হবে। সন্তানদের স্কুল থাকবে। এসব রেখে যাওয়া কষ্টদায়ক হবে।

এসব ভেবে ঢাকার বাইরে যেতেই মনস্থির করলাম। ময়মনসিংহ প্রিন্সিপাল অফিসে যোগদানের পর প্রিন্সিপাল অফিস থেকে আমাকে ময়মনসিংহ শাখা, রেজাউল করিম খানকে ত্রিশাল শাখা, আবুবকর সিদ্দিককে ময়মনসিংহ শাখা, সৈয়দ আরিফ আজাদকে ময়মনসিংহ শাখায় নিয়োগদান করা হয়।

ময়মনসিংহ শাখাটি অনেক বড় শাখা। এটি ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে একটি দর্শনীয় জমিদার বাড়ি। এই বাড়িটি এতোটাই সৌন্দর্যমণ্ডিত যে, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়ির মালিক সম্ভবত গৌরীপুর অথবা মুক্তাগাছা জমিদারদের বংশধর। একটি জমিদার বাড়ি শশী লজ ময়মনসিংহ টিচার্চ ট্রেনিং কলেজ। আর এ বাড়ির নাম এতোদিনে ভুলে গেছি। হয়তো সূর্য লজ হবে। ৮ আগস্ট ১৯৮৩ তারিখে এ শাখায় যোগদানের মাধ্যমে আমার ব্যাংকিং পেশাজীবন শুরু হলো। এ শাখার কর্ম পরিবেশ আমার বেশ ভাল লাগে। ম্যানেজার ছিলেন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মতিউর রহমান। চেহারায় যেমন গাম্ভীর্য ছিল, তেমনই ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কাছে থেকে দেখেছি , জেলা প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তারাও তাকে সমীহ করতেন।

দুজন প্রিন্সিপাল অফিসার ছিলেন। একজন রাবেয়া আপা আর অপরজন আজিজুল ইসলাম।

চলবে…

আরও পড়ুন