ঢাকা, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২২ জ্বিলকদ ১৪৪৬

ব্যাংকিং সেক্টরে ট্রেড ইউনিয়নের সেকাল-একাল (দ্বিতীয় পর্ব)

গিয়াস উদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ: ১৬:১৫, ৪ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৮:১৪, ৪ মে ২০২৫

ব্যাংকিং সেক্টরে ট্রেড ইউনিয়নের সেকাল-একাল (দ্বিতীয় পর্ব)

ব্যাংক অব ক্যালকাটা অবিভক্ত ভারতের প্রথম ব্যাংক। ১৮০৬ সালের ২ জুন তারিখে ব্যাংক অব ক্যালকাটা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৮০৯ সালের ২ জানুয়ারি তারিখে এই ব্যাংকের নাম বদলে ব্যাংক অব বেঙ্গল করা হয়। ১৮৪০ সালে ব্যাংক অব বোম্বে এবং ১৮৪৩ সালে ব্যাংক অব মাদ্রাজ প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতবর্ষে ৩টি প্রেসিডেন্সি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।  ১৯২১ সালে এ তিন ব্যাংকের সমন্বয়ে দি ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৩৫ সালে ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির আগ পর্যন্ত এই ব্যাংক ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে কাজ করে।

বেঙ্গল ব্যাংক ছিল ভারতে ব্রিটিশ আশীর্বাদপুষ্ট প্রথম আধুনিক ব্যাংক। ঢাকা ব্যাংক বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাংক যা ১৮০৬ সালে কার্যক্রম শুরু করে। ১৮৬২ সালে ঢাকা ব্যাংকের মালিকানা কিনে বেঙ্গল ব্যাংক এ অঞ্চলে তার প্রথম শাখা উদ্বোধন করে। ১৮৭৩ সালে বেঙ্গল ব্যাংক সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রামে আরও ২টি শাখা খোলে। ১৯০০ সালে চাঁদপুরে তৃতীয় শাখা উদ্বোধন করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশ অঞ্চলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুর, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জে বেঙ্গল ব্যাংকের ৬টি শাখা কার্যরত ছিল।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান নামে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানে সর্বমোট ৩৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক কার্যরত ছিল যার মধ্যে সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে শুধু ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, হাবিব ব্যাংক এবং অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংকের একটি করে শাখা ছিল। ওই সময়ে দি ইউনাইটেড ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং কমার্স ব্যাংক নামে চারটি পাকিস্তানি ব্যাংক ১৯৫৯-১৯৬৫ সময়কালে বাংলাদেশ অঞ্চলে ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করে। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের মালিকানাধীন ঢাকায় প্রধান কার্যালয়সহ মাত্র ২টি ব্যাংক ছিল। ব্যাংক দুটি হচ্ছে—ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লি.। এটিই বর্তমানে পূবালী ব্যাংক লিমিটেড এবং ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেড। এ ব্যাংক দুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যথাক্রমে ১৯৫৯ এবং ১৯৬৫ সালে।

১৯৫০ সালে ব্যাংক শাখার সংখ্যা ছিল ১৪৮টি। ১৯৬৫ সালে এ সংখ্যা ৫৪৫তে উন্নীত হয়। ১৯৬৫ সালের পরবর্তী সময়ে আর্থিক খাতে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হয় এবং ব্যাংকের শাখার সংখ্যা পরবর্তী ৫ বছরে বেড়ে ১,০৭৫টিতে দাঁড়ায়।

পাকিস্তান শাসনামলে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা কার্যত নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হতো পাকিস্তানিদের দ্বারা। বাণিজ্যিক ব্যাংক  ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাঙালিদের কোনো উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হতো না। নিচের সারির কর্মকর্তা হিসেবে কিছু বাঙালিকে নিয়োগ দেওয়া হতো। ব্যাংক ব্যবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করত পাকিস্তানিরা। প্রায় সবগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছিল পাকিস্তানে। বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাংকগুলোর কিছু শাখা ছিল মাত্র। এই শাখাগুলোও নিয়ন্ত্রিত হতো পাকিস্তানিদের দ্বারা।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ক্রেডিট ডিপার্টমেন্ট এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিপার্টমেন্ট। এই দুই ডিপার্টমেন্টে কোনো বাঙালিকে নিয়োগ দেওয়া হত না। অর্থাৎ ব্যাংকিং ব্যবস্থা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

 স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার বিদেশি ব্যাংক ব্যতীত বাংলাদেশে কার্যরত সকল পাকিস্তানি মালিকানাধীন ব্যাংক অধিগ্রহণ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিকাশের পথ তৈরি করে। ১৯৭২ সালের ব্যাংক জাতীয়করণ আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশি মালিকানাধীন ২টি ব্যাংকসহ অধিকৃত ১০টি পাকিস্তানি ব্যাংকের একত্রীকরণের মাধ্যমে ৬টি স্বতন্ত্র ব্যাংক গঠিত হয়। সেগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তান থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ১,১৩০টি শাখা নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়।

নতুন নামকরণকৃত ও পুনর্গঠিত ব্যাংকগুলো হচ্ছে: সোনালী ব্যাংক (দ্য ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, দ্য প্রিমিয়ার ব্যাংক (দ্য ব্যাংক অব বাহওয়ালপুর), অগ্রণী ব্যাংক (হাবিব ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক), জনতা ব্যাংক (দ্য ইউনাইটেড ব্যাংক, দ্য ইউনিয়ন ব্যাংক), রূপালী ব্যাংক (দ্য মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, দ্য স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক), পূবালী ব্যাংক (দ্য অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক, দ্য ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক) এবং উত্তরা ব্যাংক (দ্য ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন)। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তা বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার—১৯৭২ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান-এর ঢাকাস্থ ডেপুটি গভর্নরের অফিসকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এর সমস্ত দায় ও সম্পদ গ্রহণপূর্বক বাংলাদেশ ব্যাংকরূপে পূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মর্যাদায় উন্নীত করা হয়।

১৯৮১ সালে সরকার চিন্তা করল, এখন আমরা ব্যক্তি খাতে ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দিতে পারি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের দুর্নীতি ও অদক্ষতাই মূলত এই চিন্তার পেছনে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছিল না। তখন আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক নামে একটি ব্যাংক ব্যক্তিমালিকানায় স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর অতি দ্রুত ব্যক্তিমালিকানায় অনেকগুলো ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশে ৬টি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩টিকে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণাধীন বাকি তিনটি হচ্ছে সোনালী, জনতা এবং অগ্রণী ব্যাংক। বেসরকারি খাতে হস্তান্তরিত রূপালী ব্যাংকের মালিকানার ৫১ শতাংশ সরকারের অধীনে এবং ৪৯ শতাংশ পাবলিক শেয়ার। এর মালিকানা পরিবর্তন হয় ১৯৮৩ সালে। সরকারের শেয়ার বেশি বিধায় রূপালী ব্যাংককে অনেক দলিলেই সরকারি ব্যাংক হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে। অপর ২টি বিরাষ্ট্রীয়কৃত ব্যাংক উত্তরা ব্যাংককে ১৯৮৩ সালে এবং পূবালী ব্যাংককে ১৯৮৬ সালে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে হস্তান্তর করা হয়।

দেশে কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে যেগুলি সুনিদিষ্ট অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (১৯৭৩) এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (১৯৮৭) প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থায়নের জন্য। শিল্প উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অর্থায়নের জন্য ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক। অপরদিকে আত্ম-কর্মসংস্থান কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের জন্য ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় কর্মসংস্থান ব্যাংক। এছাড়া সমবায়ী জনগণকে ঋণ প্রদান ও তাদের সঞ্চয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালে সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা আজও একই উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সহায়তা প্রদানের জন্য ১৯৯২ সালে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশের শিল্প প্রকল্পসমূহকে ঋণ সহায়তা প্রদান ও পুঁজিবাজার উন্নয়ন ও বিনিয়োগ কর্মকান্ডের ভিতকে সম্প্রসারিত করণে ১৯৭২ সালে শিল্প ঋণ সংস্থা গঠন করা হয়।

পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালে এটিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদান করা হয়। দেশের আর্থিক খাতের বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে শিল্পে প্রয়োজনীয় ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকে একীভূত করে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক (বিডিবিএল) প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে মোট বিশেষায়িত ব্যাংকের সংখ্যা ৪টি।

পাকিস্তান আমলে প্রিমিয়ার  ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন নং ডি-২০২ নামে একটি ট্রেড ইউনিয়ন  সংগঠন ছিল । ১৯৭৩ সালে সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন রেজি নং বি-৬৬৪ প্রতিষ্ঠা হয়। এ সংগঠনের সভাপতি হন এম এ হান্নান এবং সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নান। আর জামাল উদ্দিন আহমেদ সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৭৭ সালে হান্নান মান্নানকে বাদ দিয়ে সিলেটের আব্দুস শহীদ সভাপতি ও  জামাল উদ্দিন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক হন। তখন ব্যাংকিং সেক্টরে সারাদেশে ট্রেড ইউনিয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়। নিত্যনতুন দাবি পেশ ও আদায় হতে থাকে। বিশেষ করে ফ্রি মেডিকেল। একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী তখন মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা ফ্রি মেডিকেল পেতেন। ফ্রিন্জ বেনিফিট, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ছাতা জুতা, পোশাকসহ বহু দাবি আদায় হয়। আশি সালে বিষয় ৬৬৬ এর সভাপতি আব্দুস শহীদ অফিসার হয়ে গেলে সভাপতির দায়িত্ব পান কুমিল্লার রফিকুল ইসলাম স্বপন। ১৯৮১ সালে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন সিলেটের ইজাজুদর রহমান। তিনি অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের আত্মীয় ছিলেন। তিনি ব্যাংক কর্মচারীদের ফ্রি মেডিকেল বন্ধ করে দেন। ফলে মতিঝিল ব্যাংক পাড়া উত্তপ্ত হতে থাকে।

প্রতিদিন মিছিল মিটিং চলতে থাকে। একদিন মিছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং এমডি ইজাজুল রহমানের উপর হামলা করা হয়। ওইদিন রাতেই ব্যাংক নেতা জামাল উদ্দিন গ্রেফতার হন। সারাদেশে ব্যাংকস এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের ডাকে ১৪-১৫ দিন ব্যাংক ধর্মঘট পালিত হয়। সাত্তার সরকার কঠোর অবস্থান নেন। সারাদেশে ১১ হাজারের অধিক ব্যাংক কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বিশেষ করে জামাল উদ্দিনের অনুসারী সংগঠনের কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং ব্যাংক নিরাপত্তা কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা হয়। ১৯৮১ সালের ব্যাংক ধর্মঘট ব্যাংকিং সেক্টরের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়।

চলবে  ....

আরও পড়ুন