ঢাকা, রোববার, ২৫ মে ২০২৫

১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৬ জ্বিলকদ ১৪৪৬

বাংলাদেশি টাকার রূপান্তরযোগ্যতা

ব্যাংকার প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৯:৫০, ২৪ মে ২০২৫ | আপডেট: ১৯:৫০, ২৪ মে ২০২৫

বাংলাদেশি টাকার রূপান্তরযোগ্যতা

১৯৯৪ সালের ২৪ মার্চ আইএমএফ চুক্তির অনুচ্ছেদ ৮ অনুসারে চলতি হিসাব লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি টাকা রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা দেশের বিনিময় ব্যবস্থাপনা এবং বিনিময়হার ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করে। এর আগে বৈদেশিক পরিশোধ  এবং বিনিময়হার ব্যবস্থাপনার উপর নিয়ন্ত্রণ সহজ করার লক্ষ্যে দেশের আর্থিক খাত বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্ববধানে সংস্কার বিষয়ে উদ্যোগবহুল একটি সময় পার করে।

এই উদ্যোগের ফলে দু-একটি সংরক্ষিত খাত বাদে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের শিল্পখাতে উন্মুক্তভাবে বিনিয়োগ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে একটি শিল্পোদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন কিংবা সম্পূর্ণভাবে তাদের মালিকানায়ও এটি হতে পারে। উদ্যোক্তারা নিজেদের তহবিল ব্যবহার করলে এ ধরনের উদ্যোগের জন্য কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই। অবশ্য, শিল্পখাতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বোর্ড  এর অধীনে রেজিস্ট্রেশনের আবেদন করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়।

মূলধন হিসেবে বাংলাদেশে আনীত যন্ত্রাদির বিপরীতে বিদেশি বিনিয়োগকারীর অনুকূলে শেয়ার ইস্যু করা যেতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে মূলধনী যন্ত্রপাতির ফর্মে শেয়ার ইস্যুর জন্য কাস্টম কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে মূলধনী যন্ত্রপাতির এন্ট্রি এভিডেন্স বিলের এক্সচেঞ্জ কন্ট্রোল কপি, সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পারমিটসমূহ, ইনভয়েস এবং বিল অব লেডিং এর প্রয়োজন হয়।

এই রূপান্তরযোগ্যতার ফলে স্টক এক্সচেঞ্জের নিয়মকানুনে যেমনটি উল্লেখ আছে, অনিবাসীগণ শেয়ার/ সিকিউরিটিজে উন্মুক্তভাবে বিনিয়োগ করতে পারেন। তারা নতুন বা তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ বাংলাদেশি শেয়ার/ সিকিউরিটিজেও বিনিয়োগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের নিবন্ধিত ব্রোকার/ স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যদের মাধ্যমে লেনদেন করার প্রয়োজন নেই। অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য একটি কোম্পানির ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং এর ৫% শেয়ার সংরক্ষিত। অনিবাসী বাংলাদেশিগণ ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রায় বিনিয়োগ করতে পারবেন। এ ছাড়া অনিবাসীদের অনুকূলে বাংলাদেশে তাদের যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু বা ট্রান্সফারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। অনিবাসী শেয়ার হোল্ডারগণ অন্য অনিবাসীদের কাছে উন্মুক্তভাবে শেয়ার ট্রান্সফার করতে পারবেন।

এ ব্যবস্থার ফল হিসেবে বিদেশি ফার্ম/কোম্পানি বা ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখাসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়াই তাদের ট্যাক্স-উত্তর মুনাফা অনুমোদিত ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের হেড অফিসে পাঠাতে পারবে। এই রূপান্তরযোগ্যতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে নিয়ে এসেছে। 

অনিবাসী বাংলাদেশিদের বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে লভ্যাংশের রেমিট্যান্স প্রেরণ, পূর্ববর্তী বছরের মোট রিজার্ভের উপর ঘোষিত রেমিট্যান্সের লভ্যাংশ কিংবা বাংলাদেশের কোনো স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত শেয়ার এবং কোম্পানির লভ্যাংশ এবং সেল প্রসিডস (ক্যাপিটাল গেইনসহ) এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন নেই। অবশ্য স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ারের সেল প্রসিডস এর রেমিট্যান্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন হবে। কারণ, ট্যাক্সের প্রকৃত পেমেন্টের আগে এ ধরনের রেমিট্যান্স ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বহন করে; কেননা ক্ষেত্রবিশেষে ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের নিকট প্রকৃত পরিশোধযোগ্য ট্যাক্সের পরিমাণ কোম্পানি কর্তৃক স্থগিত হয়ে থাকে।

টাকার রূপান্তরযোগ্যতা প্রবাসীদের বেতনের অংশ দেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতা কমিয়ে নিয়ে এসেছে। সরকারের অনুমোদন নিয়েই বাংলাদেশে কর্মরত প্রবাসীগণ অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে তাদের বেতনের ৫০% এবং ছুটিকালীন বেতনের ১০০% দেশে পাঠাতে পারবেন। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন নেই।

শিল্পোদ্যোগ পূর্বানুমোদন ছাড়াই বিদেশে রয়ালটি/ কারিগরি সহায়তা ফি সংক্রান্ত পেমেন্ট চুক্তি খাতে প্রবেশ করতে পারবে যদি টেকনোলজি ট্রান্সফারের জন্য প্রয়োজনীয় মোট ফি এবং খরচাদি (ক) আয়কর বিবরণীতে ঘোষিত পূর্ববর্তী বছরের বিক্রয়ের ৬% এর বেশি না হয় (খ) নতুন প্রোজেক্টের ক্ষেত্রে যন্ত্রাদির আমদানি খরচের ৬% এর বেশি না হয়। অবশ্য এই চুক্তিসমূহ বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের আওতায় নিবন্ধিত হতে হবে। এই জেনারেল গাইডলাইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন চুক্তির জন্য বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন হবে। অনুমোদিত ডিলারগণ বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের আওতায় নিবন্ধিত বা বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত চুক্তি অনুসারে রয়ালটি, কারিগরি জ্ঞান/ কারিগরি সহায়তা বাবদ প্রদেয় ফি এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রেরণ করতে পারবেন। এর জন্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন হবে না।

তা ছাড়া স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদনশীল শিল্পসমূহ অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে পূর্ববর্তী বছরের আয়কর বিবরণীতে প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শবাবদ উল্লিখিত বিক্রয়ের ১% পর্যন্ত দেশে পাঠাতে পারবেন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন নেই। বিদেশি নৌ, আকাশ বা কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিসমূহ অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফ্রেইট এবং প্যাসেজের অনুকূলে সংগৃহীত তহবিল প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্থানীয় খরচ এবং ট্যাক্স সমন্বয়ের পর বিদেশ পাঠাতে পারবে।

শিল্পোদ্যোগকেও এই রূপান্তরযোগ্যতা অনেক সহজ করে দিয়েছে। বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তাগণ (স্থানীয়, বৈদেশিক অথবা যৌথ) বিদেশ থেকে অর্থ ধার করতে পারবেন। বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের অনুমোদিত ধারের শর্তানুসারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়াই অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে পেমেন্ট অব ইন্টারেস্ট এবং পেমেন্ট অব প্রিন্সিপাল
বরাবর রেমিট্যান্স প্রেরণ করা যাবে।

বাংলাদেশের ব্যাংকসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই স্থানীয় মুদ্রার ক্যাপিটাল লোন বা টার্ম লোন বাংলাদেশে কার্যরত বৈদেশিক ফার্ম/কোম্পানির সঙ্গে (প্রস্তুতকারক বা প্রস্তুতকারক নয়) স্বাভাবিক ব্যাংকার-কাস্টমার সম্পর্কে উন্নীত করতে পারবে। বাংলাদেশে কার্যরত ব্যাংকসমূহ স্থানীয় মুদ্রা (বিদেশ থেকে প্রাপ্ত স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ পর্যন্ত) ইপিজেড-এর শিল্পসমূহের যৌথ উদ্যোগে মঞ্জুর করতে পারে।

বাংলাদেশি টাকা বাণিজ্য সম্পর্কিত সকল লেনদেনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরযোগ্য। কন্ট্রোল লিস্টে নেই এমন পণ্যের আমদানির জন্য ইম্পোর্ট লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই। কন্ট্রোল লিস্টের অথবা তার বাইরের যে কোনো পণ্য আমদানির জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের সুনির্দিষ্ট বা সাধারণ অনুমোদন সাপেক্ষে একজন আমদানিকারকের বৈদেশিক বিনিময়ে স্বয়ংμিয় প্রবেশগম্যতা রয়েছে।

রপ্তানিকারকদের জন্যও টাকার রূপান্তরযোগ্যতা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। নতুন রপ্তানিরকারকদের জন্য বিদেশে ব্যবসা সংক্রান্ত ভ্রমণের জন্য বার্ষিক বৈদেশিক বিনিময় কোটা ৬,০০০ ডলার ধার্য করা হয়েছে। ৬,০০০ ডলারের উপরে যদি আরও অর্থের প্রয়োজন হয় তাহলে উপযুক্ত দলিলাদিসহ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাকি অর্থের সংস্থান বাংলাদেশ ব্যাংক নিজ দায়িত্বে করার উদ্যোগ নিয়েছে।

সূত্র্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস

এএ

 

ব্যাংকার প্রতিবেদন

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন