ঢাকা, রোববার, ০৮ জুন ২০২৫

২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১০ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ও ক্ষমতা

ব্যাংকার প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৮:৩৫, ৭ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৩৫, ৭ জুন ২০২৫

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ও ক্ষমতা

মানিলন্ডারিং বলতে বোঝায় অবৈধ পথে আয়ের উৎস গোপন করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন লেনদেন করে অর্থ পাচার। তিনটি পর্যায়ে মানিলন্ডারিং করা হয়। এগুলো হলো- প্লেসমেন্ট, লেয়ারিং এবং ইন্টিগ্রেশন। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

প্লেসমেন্ট পর্যায়ে অবৈধ অর্থ সরাসরি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো হয়। সাধারণত, ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার মাধ্যমে এটি শুরু হয়। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, অবৈধ অর্থের লেনদেনের পরিমাণ বেশ বড় হয়। সেক্ষেত্রে ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা জমা দিতে গেলে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।

লেয়ারিং পর্যায়ে অর্থকে বিভিন্ন পন্থায় এক খাত থেকে আরেক খাতে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে টাকা এক হিসাব থেকে আরেক হিসাবে, এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের হিসাবে, এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাঠিয়ে লেনদেনের একটা জটিল অবস্থা তৈরি করা হয়, যাতে লেনদেনগুলো অনুসরণ করা না যায়। অর্থাৎ কোনো লেনদেনের ধারাবাহিকতা নির্ধারণ করা যায় না। ফলে মূল উৎসটিও বের করা সম্ভব হয় না।

ইন্টিগ্রেশন পর্যায়ে অর্থ আবারও মূল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। তবে এবার অবৈধ অর্থ হিসেবে নয়। বৈধ অর্থ হিসেবেই এ টাকা অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে আগের প্রমাণ না থাকলে এই অর্থের উৎস বের করা প্রায় অসম্ভব। সাধারণত ব্যবসায় লাভ হিসেবে ব্যাংকে
এ অর্থ জমা করা হয়।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০০২ এ বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিল। এ দায়িত্ব পরিপালনের জন্য ২০০২ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০০২ সংশোধনের প্রয়োজন পড়ে। ২০০৮ সালে মানিলন্ডারিং আইন ২০০২ কে প্রতিস্থাপন করে মানিলন্ডারিং অধ্যাদেশ ২০০৮ জারি করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে উক্ত অধ্যাদেশটি অপরিবর্তিত অবস্থায় আইনে পরিণত করা হয়।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ থেকে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ডাকঘর, মানি চেঞ্জার, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট ইন্টারমিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেক্টরের জন্য গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় সার্কুলার প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৮ সালে সকল ব্যাংকের জন্য অভিন্ন ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম প্রণয়ন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আইনটি অধিকতর যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে মানিলন্ডারিং আইন ২০০৯ সংশোধন করে মানিলন্ডারিং আইন ২০১২ প্রণয়ন করা হয়। মানিলন্ডারিং আইন ২০১২ এর ২৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নামে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট গঠন করা হয়। এ ইউনিট বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিভাগ হিসেবে কাজ করলেও এটির একটি ইন্টারনাল ম্যানুয়াল রয়েছে। এ ইউনিটের প্রধান ও উপপ্রধান হলেন ইউনিট সংশ্লিষ্ট ডেপুটি গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালক, অপারেশনাল প্রধান হলেন এ ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক।

মানিলন্ডারিং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন দমনে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আলোচ্য কার্যক্রম প্রশংসিত হয়েছে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০০২ জারি হবার পর এর বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ’ ও পরবর্তী সময়ে মানিলন্ডারিং আইন ২০১২ এর ২৪ ধারা অনুযায়ী গঠিত ‘বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ আলোচ্য আইনের সার্বিক পরিপালনে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। আইনের উদ্দেশ্য পূরণের নিমিত্তে দেশ জুড়ে এক ও অভিন্ন প্ল্যাটফরম তৈরিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গ্রাহক, ব্যাংকার ও সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তিবর্গের জ্ঞাতার্থে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করছে।

এক্ষেত্রে মানিলন্ডারিং ঝুঁকি নির্মূলে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ হলো:

১. কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিট : মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০২ এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অবৈধ টাকা প্রথমেই যেহেতু বাণিজ্যিক ব্যাংকে জমা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি সতর্ক নজরদারির নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাছাড়া নতুনভাবে কোনো হিসাব/পলিসি খোলার সময় গ্রাহকের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। গ্রাহকের সম্ভাব্য লেনদেনের অনুমিত মাত্রাজনিত ঘোষণা গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়া একজন গ্রাহকের বর্তমান পেশা বা পেশাসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তথ্য রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো গ্রাহকের হিসাবে অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক লেনদেন সংঘটিত হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে।

এ ইউনিটের প্রধান হচ্ছেন প্রধান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা। এ কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধমূলক কার্যাবলি যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হচ্ছে বলে নিশ্চিত করে থাকেন। আবার প্রত্যেক রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার প্রতিটি শাখায়/এজেন্সিতে একজন করে শাখা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা নিয়োগ করে শাখা/এজেন্সি পর্যায়ে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করা এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় রিপোর্ট করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

২. মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে গাইডেন্স নোট প্রণয়ন : বাংলাদেশে কর্মরত সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকে একই নিয়ম চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসম্বলিত মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ গাইডেন্স নোট প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে এই গাইডেন্স নোট মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাছাড়া মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ গাইডবুক নামে সহজ ভাষায় লিখিত একটি বই বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে প্রদান করা হয়েছে। এ বইটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রাথমিক তথ্যাদিসম্বলিত পুস্তিকা বলে বিবেচিত হচ্ছে।

৩. প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান : মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের করণীয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ থেকে সার্কুলার ইস্যু করা হয়। এসব সার্কুলারের মাধ্যমে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুসরণ করায় এদেশে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম আরও সহজ ও সাবলীল হয়েছে।

৪. কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব প্রদান : মানিলন্ডারিং, চোরাচালান ও অন্যান্য অপরাধ দমনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে গঠিত কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধি, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ রয়েছেন। এছাড়া, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর ও বরিশাল অর্থাৎ ঢাকার বাইরে যেসব শহরে বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা অফিস রয়েছে সেসব শহরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে আঞ্চলিক টাস্কফোর্স একই লক্ষ্যে কাজ করছে। আঞ্চলিক টাস্কফোর্সেও স্থানীয় প্রশাসন ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের সভা দ্বিমাসিক ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মানিলন্ডারিং, চোরাচালান এবং এ ধরনের অপরাধ দমনে সমস্যা, সমাধানের উপায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং কৌশল নির্ধারণ করা হয়।

৫. আন্তর্জাতিক মানিলন্ডারিং প্রতিরোধমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা : মানিলন্ডারিং বর্তমানে কোনো একটি দেশের একক এজেন্ডা নয়। বিশ্বব্যাপী প্রায় সকল দেশ মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন দমনে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশসমূহের এসব কাজ মনিটরিং করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মানিলন্ডারিং দমনসংক্রন্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিং-এর সদস্য। বাংলাদেশ প্রতি বছর এ প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক চাঁদা পরিশোধ করে এবং এর বার্ষিক সাধারণ সভায় উপস্থিত থেকে মতামত প্রদান করে। তাছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোর সংস্থা এগমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ লাভ করেছে।

৬. সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান : বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রধান রিপোর্টিং সংস্থা। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ ২০০৮ এর ২৩ (১) (চ) ধারায় রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনায় যে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ সভা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হিসেবে বলা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনায় যে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ সভা, সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করতে হবে। উল্লিখিত ধারার নির্দেশনা অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। তাছাড়া দেশব্যাপী বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখাসমূহের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। আবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদেরও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

৭. জনসচেতনতা সৃষ্টি : মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রন্ত বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বক্তব্য প্রচারের ব্যবস্থা এবং রোড শো’র আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিটি শাখা থেকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক বক্তব্য সম্বলিত মুদ্রিত লিফলেট বিতরণ ও ব্যাংক শাখার অভ্যন্তরে দর্শনীয় স্থানে লিফলেট সাঁটানোর মাধ্যমে গ্রাহকদের এ বিষয়ে সচেতন করার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে।

৮. অভ্যন্তরীণ সহযোগিতা : মানিলন্ডারিং অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল এজেন্সি হলেও এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এককভাবে মানিলন্ডারিং দমন করা সম্ভব নয়। অপরাধ চিহ্নিতকরণ, তদন্ত, দমন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ রাইফেলস এরূপ সকল পক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সমঝোতা রক্ষা করে মানিলন্ডারিং অপরাধ দমনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) এবং অলাভজনক সংস্থাকে (এনপিও) নিজস্ব নীতি প্রণয়ন করতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ থেকে জারিকৃত সার্কুলারে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। মানিলন্ডারিং আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জারিকৃত এ নির্দেশনায় বলা হয়, ঐ নীতি সংশ্লিষ্ট সংস্থার পরিচালনা পর্ষদ বা সর্বোচ্চ কমিটির অনুমোদিত হতে হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংককে তা অবহিতকরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সার্কুলার অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক এনজিও এবং এনপিওকে রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। একই নির্দেশনায় এনপিও বলতে প্রচলিত কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ করে। এসব আইনে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে যে কোনো ধরনের বৈদেশিক সাহায্য,  অনুদান বা ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান বা যেসব প্রতিষ্ঠান নিজ তহবিল সংগ্রহ করে বা অন্যকে সরবরাহ করে তাদের নিজস্ব নীতি প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়। উক্ত নির্দেশনায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার জন্য সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ‘কন্ট্যাক্ট পয়েন্ট’ মনোনয়ন করতে বলা হয়। এছাড়া এনজিও বা এনপিওকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং কাজের বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজন অনুযায়ী যেন তথ্য সরবরাহ করা যায় এজন্য তাদের সার্বিক তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহে রাখতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় প্রতিটি এনজিও এবং এনপিওর নিরীক্ষিত বার্ষিক আর্থিক বিবরণী পাঁচ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। যেসব গ্রাহকের ঋণ বা জমার স্থিতি ২৫ হাজার টাকা বা তার বেশি, সেসব গ্রাহকের বিস্তারিত পরিচিতি কমপক্ষে পাঁচ বছরের জন্য সংরক্ষণে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এক লাখ টাকা বা তার বেশি লেনদেনের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। এ নির্দেশনায় আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নিয়োগের আগে ঐ প্রতিষ্ঠান যেন তার বিস্তারিত পরিচিতি সংগ্রহ করে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া বিদেশে অবস্থিত শাখার কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ এবং সেখানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতিটি এনজিও বা এনপিওকে তাদের গ্রাহকদের প্রদত্ত তহবিল মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থ জোগানে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়। দাতা সংস্থা বা ব্যক্তির বিষয়ে এ ধরনের কোনো সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে তা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

৯. goAMLসফ্টওয়্যার বাস্তবায়ন : আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রমকে আরও সুসংহত করা এবং এর সম্ভাব্য উৎস সনাক্তকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নেয়, যার মাধ্যমে দেশের মুদ্রা পাচার প্রতিরোধে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন  এবং নগদ লেনদেন প্রতিবেদন সংক্রান্ত তথ্য সহজে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। সিটিআর ও এসটিআর বিষয়ক অনলাইন রিপোর্টিংয়ের জন্য জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম থেকে goAML সফ্টওয়্যার সংগ্রহ করে তা বাস্তবায়ন করা হয়।

মানিলন্ডারিং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের উদ্যোগ
মানিলন্ডারিং প্রক্রিয়া শুরু হয় অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ প্লেসমেন্টের মাধ্যমে। প্লেসমেন্টের প্রধান খাত হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকে তহবিল জমাকরণ। এজন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে যথাযথ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

মানিলন্ডারিং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:

১. কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিট প্রতিষ্ঠা : মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ব্যাংকের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব প্রদানসহ যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা, শাখার কাজ মনিটর করা, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষা করা এবং সর্বোপরি একটি সিস্টেম উন্নয়নের মাধ্যমে নিজ ব্যাংককে মানিলন্ডারিং ঝুঁকি থেকে রক্ষা করাই কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিটের কাজ। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়েই কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ঊর্ধ্বতন নির্বাহী কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিট পরিচালনা করে থাকেন। এক্ষেত্রে তিনিই ঐ ব্যাংকের প্রধান মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা বলে বিবেচিত।

২. শাখা পর্যায়ে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধমূলক সিস্টেম উন্নয়ন : বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় অস্বাভাবিক লেনদেন চিহ্নিতকরণ, সন্দেহজনক লেনদেন সনাক্তকরণ, এগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিটে রিপোর্টকরণই শাখা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমের উদ্দেশ্য। তাছাড়া শাখাকে ব্যবহার করে কোনো মানিলন্ডারার যেন মানিলন্ডারিং করতে না পারে সে বিষয়েও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ সিস্টেম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। শাখা পর্যায়ে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যμমে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য প্রতিটি শাখায় একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ঊর্ধ্বতন নির্বাহীকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এরূপ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শাখা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা বলা হয়ে থাকে।

৩. কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান : মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান খুবই জরুরি। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকের উদ্যোগে নিজ নিজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। বিশেষ করে গ্রাহকের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ডেস্কসমূহে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের জন্য গুরুত্বের সঙ্গে এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

৪. অস্বাভাবিক লেনদেন সনাক্তকরণ : বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিটি শাখার দৈনন্দিন লেনদেনগুলো সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হয়। কোনো শাখায় কোনো অস্বাভাবিক লেনদেন সনাক্ত করা গেলে  তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি শাখা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তার নজরে আনা হয়। এ বিষয়ে শাখা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ পরিপালন কর্মকর্তা কর্তৃক বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হয় এবং বিষয়টি শাখা ব্যবস্থাপকের অবগতিতে আনা হয়ে থাকে।

৫. সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্টকরণ : শাখায় সনাক্তকৃত অস্বাভাবিক লেনদেন সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে লেনদেনগুলো অস্বাভাবিক বলে বিবেচিত হলে বা এসব লেনদেনের সঙ্গে মানিলন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন জড়িত থাকতে পারে বলে অনুমিত হলে অনতিবিলম্বে তা নির্ধারিত ফরমে ব্যাংকের কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিটে রিপোর্ট করা হয়। কেন্দ্রীয় পরিপালন ইউনিট থেকে প্রতিবেদনটি পাবার পর এ ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত করে উক্ত ইউনিটের বিবেচনায় প্রকৃতই এগুলো সন্দেহজনক বলে বিবেচিত  হলে মন্তব্যসহ নির্ধারিত ফরমে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে রিপোর্ট করা হয়।

৬. নগদ লেনদেন রিপোর্টকরণ : বাণিজ্যিক ব্যাংকের কোনো শাখায় কোনো একজন গ্রাহকের হিসাবে একদিনে এক বা একাধিক লেনদেনের ফলে যদি নগদে দশ লক্ষ টাকার অধিক জমা বা উত্তোলন করা হয়, তাহলে বিষয়টি নির্ধারিত ফরমে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করা হয়। এ ধরনের রিপোর্ট যদিও একটি রুটিন ব্যবস্থা এবং সন্দেহজনক কোনো কিছু নয়, তবু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে এ রিপোর্ট সহায়ক হতে পারে।

৭. মানিলন্ডারিং প্রতিরোধমূলক প্রচারণার আয়োজন : বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিটি শাখা থেকেই মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত তথ্যজ্ঞাপক লিফলেট গ্রাহকদের কাছে বিলি করা হয়। এছাড়া বাণিজ্যিক  ব্যাংকগুলোর উদ্যোগে মিডিয়াতে নিয়মিত সতর্কবাণী প্রচার করা হয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এ ধরনের প্রচারণার ফলে ব্যাপক গণসচেতনতা বাড়ছে এবং ব্যাংকের ক্ষেত্রে আইনের প্রায়োগিক দিকের পরিপালন সহজতর হচ্ছে। এ বিষয়টি চিন্তা করে এ সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক একক ও যৌথভাবে কাজ করে চলেছে।

 এ ইউনিট থেকে জারিকৃত নির্দেশনাসমূহ পরিপালনের জন্য ওয়ার্কশপ, প্রশিক্ষণ, সভা, সেমিনারের আয়োজন করা হয়। নিয়মিতভাবে পুলিশ ও দুর্নীতি দমন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করা হয়।

সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস

এএ

ব্যাংকার প্রতিবেদন

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন