ঢাকা, রোববার, ২৭ জুলাই ২০২৫

১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ০১ সফর ১৪৪৭

২০২৫ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৌশলগত প্রস্তুতির ওপর জোর

ব্যাংকার প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২২:৫১, ২৬ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ২২:৫২, ২৬ জুলাই ২০২৫

২০২৫ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৌশলগত প্রস্তুতির ওপর জোর

আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি)-এর ৩০তম বার্ষিক কাউন্সিল আজ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ু ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যেন ২০২৫ সালের কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারে, সেজন্য কৌশলগত প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন কাউন্সিলের সদস্যরা।

শনিবার (২৬ জুলাই) ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান নির্বাহী বোর্ডের পক্ষে বৈশ্বিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল। রেড সি সংকট, ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধ এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবারও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় বাণিজ্য জাতীয়তাবাদের প্রবণতা বেড়েছে।

কাউন্সিলে জানানো হয়, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাত্র ২.৮ শতাংশ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ এই অনিশ্চয়তা আরও বাড়াচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ও রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতির কারণে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ছিন্নভিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য চিন্তার বিষয়।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কার মুখে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। আইএমএফ ও এডিবি বলেছে, এ হার হতে পারে যথাক্রমে ৩.৮ শতাংশ ও ৩.৯ শতাংশ। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ  ছাড়িয়ে গেছে, খাদ্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ। বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলেছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দুর্বল অবস্থাও বড় একটি উদ্বেগের বিষয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড ৩.৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা ছাড়িয়ে যায়। যার বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। ১৯টি ব্যাংক ১.৭১ ট্রিলিয়ন টাকার মূলধন ঘাটতির কথা জানিয়েছে। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে যেমন: ব্যাংক বোর্ড বাতিল, ব্যাংক একীভূতকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ জোরদার।

২০২৬ সালের নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ করবে এই বাস্তবতার দিকেও দৃষ্টি রেখেছে আইসিসিবি। এতে বিশেষ করে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাতে পারে বাংলাদেশ। ফলে ইইউ ও যুক্তরাজ্যের মতো বাজারে সর্বোচ্চ ১১.৫ শতাংশ শুল্ক গুণতে হতে পারে। তাই রপ্তানিযোগ্যতা ও বিদেশি বিনিয়োগ ধরে রাখতে একটি কার্যকর উত্তরণ কৌশলের ওপর জোর দেওয়া হয়।

এছাড়া কাউন্সিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে:

জ্বালানি নিরাপত্তা: বৈদেশিক জ্বালানির ওপর নির্ভরতা এবং টাকার মান কমে যাওয়ায় জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে। এর সমাধানে ঘরোয়া অনুসন্ধান ও নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ জরুরি।

 রাজস্ব ঘাটতি: জিডিপির তুলনায় কর আহরণ মাত্র ১০ শতাংশের নিচে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠনের মাধ্যমে এই দুর্বলতা দূর করা সম্ভব, জলবায়ু ও খাদ্য নিরাপত্তা: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিতে পারে বছরে ২ শতাংশ পর্যন্ত।

বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৈচিত্র্য: ২০২৩ সালে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভিয়েতনামে তা ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলার। পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমাতে ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আইটি খাতে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

সাইবার নিরাপত্তা: ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসারে সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। তাই দ্রুত জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো ও আইনি নিয়ন্ত্রণ গড়ে তোলার তাগিদ দেওয়া হয়।

 যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শুল্ক: ৩৫ শতাংশ আমদানি শুল্কের প্রস্তাব বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের বড় ধাক্কা দিতে পারে। এ নিয়ে ন্যায্য বাণিজ্যিক সমঝোতার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি টাস্কফোর্স গঠনের  প্রস্তাব দেওয়া হয়।

সবশেষে, বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) করিডোরের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়। সুষ্ঠু অবকাঠামো ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ২০৩৫ সালের মধ্যে এই অঞ্চলের সম্মিলিত জিডিপি ৮.৩ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁতে পারে। এতে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে একটি কৌশলগত ট্রানজিট হাব।

আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, সংস্কার, সহনশীলতা এবং আঞ্চলিক সংযুক্তিকরণ এই তিনটি ভিত্তিকে সামনে রেখে টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আইসিসিবি দৃঢ়ভাবে কাজ করবে।

সভায় ২০২৪ সালের অডিট রিপোর্ট অনুমোদন এবং ২০২৫ সালের জন্য অডিটর নিয়োগ করা হয়।

ব্রুনাই দারুসসালাম এর হাইকমিশনার হাজি হারিস বিন হাজি ওসমান, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ইউ কিয়াও সোয়ে মোয়ে, আর্জেন্টিনার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ম্যাক্সিমিলিয়ানো রোমানেলো এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিক অফিসার বরুণ কুমার দে বিশেষ অতিথি হিসেবে এই কাউন্সিলে উপস্থিত ছিলেন।

ব্যাংকার প্রতিবেদন

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন