ঢাকা, সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫

২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১২ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

ইয়াছিনের পেলা

মোঃ আঃ রহিম

প্রকাশ: ১৪:৩৪, ৯ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৪:৩৫, ৯ জুন ২০২৫

ইয়াছিনের পেলা

(পূর্ব প্রকাশের বাকি অংশ)

ছয়
১৯৮৭ সালে সাভার কলেজে ভর্তির পর বাড়ি থেকে ০৭ কি.মি. পথ পায়ে হেঁটে কলেজে যেতে হতো। আবার ৭ কি.মি. পথ পায়ে হেঁটে বাড়িতে ফিরে আসতে হতো। সকাল ৭.৩০ এর মধ্যে খাবার খেয়ে বের হয়ে, আবার সন্ধ্যা বেলা বাড়িতে ফিরতে হতো। প্রতিদিন বাবার কাছ থেকে ২ টাকা নিয়ে যায় সাভারের ভাগলপুরে খেয়াঘাটের নৌকা ভাড়ার জন্য। দুপুরে ২ টাকা দামের পুরি কিনে খাওয়ার টাকাও পকেটে থাকতো না। এমনিভাবে নিয়মিত হেঁটে ১৪ কি.মি. পথ আসা-যাওয়া করার কারণে শারীরিকভাবে সে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মায়ের চাচা ভূমদক্ষিণ গ্রামের প্রকৌশলী লোকমান হোসেন বিশ্বাস সাহেবের বড় মেয়ে শাহনাজ পারভীন সম্পর্কে তার খালা তাকে মায়া দেখিয়ে তাদের সাভার ব্যাংক কলোনীর বাসায় আলাদা একটি রুমে রেখে বিনা পয়সায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এতে প্রতিদিনের ক্লান্তি দূর হলো। পারভীন খালা তার চেয়ে দুই ক্লাসের বড় হলেও এসএসসিতে খারাপ করার কারণে তাদের সাথে সাভার কলেজে মানবিক বিভাগে পড়তেন। খালার কেনা বিভিন্ন লেখকের পাঠ্য বই যা তার পক্ষে কেনা সম্ভব হয়নি তা পড়ার সুযোগ হলো। এই সহযোগিতা পেয়ে সবটুকু সময় কাজে লাগিয়ে এইচএসসিতেও প্রথম বিভাগ পায়। পারভীন খালার মা অত্যন্ত আন্তরিক, হাসিখুশি ও আদুরে স্বভাবের মানুষ। তাদের সকলের আদর ও আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে সফলভাবে এইচএসসি সমাপ্ত হলো।

বাড়ি থেকে সাভার কলেজে আসা যাওয়ার দুরত্ব ১৪ কি.মি পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়ে ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে প্রায় প্রতিদিনই তার মনে হতো, “হায়রে সাভার, আগামীকাল সকালেই আসতে হবে। অথচ একটি রাত থাকার জায়গা নাই!” এরূপ অনুভূতি ও কষ্টের দিনে পারভীন খালা ও তার পরিবার পাশে দাঁড়িয়েছে, থাকা খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। লেখাপড়ার পথ সুগম করেছে। সাভার কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় একদিন সাভার সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের পাশে সাভার কলেজের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ দীপক রায় স্যারের হোমিও ল্যাবে বসে ইনকিলাব পত্রিকায় বাণী চিরন্তনীতে সে পড়ে, “নিরাপত্তাহীনতা মহত্ত্বের জন্ম দেয়।”

সত্যিই নিরাপত্তাহীন জীবন পথ খুঁজে খুঁজে একদিন নিরাপত্তা পায় এবং মহৎ হয়ে উঠে। অনেক মহৎ প্রাণের ছোঁয়ায়, অনেক মহৎ প্রাণের ত্যাগ, ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনার বিনিময়ে নিরাপত্তাহীন জীবন নিরাপদে বেড়ে উঠে। একসময় গড়ে উঠে নিরাপত্তাপূর্ণ মহৎ জীবন, উন্নত জীবন। নিরাপত্তাহীন জীবন থেকে নিরাপদ জীবন, এই পথ পরিক্রমায় পাশে থাকা প্রতিটি মহৎ প্রাণ নিরাপত্তাপূর্ণ জীবন গড়ার ক্ষেত্রে একেকটি মহতি পেলা।

সাত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর জয়মন্টপ উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক জনাব আঃ আজিজ খান সাহেবের স্ত্রী জনাবা রাজিয়া বেগম যিনি পরবর্তীতে তার শাশুড়ি এর সহযোগিতায় তার বোনের বাসায় ০৭নং উত্তর মৌশুন্ডি, ঢাকায় প্রথম টিউশনি পায় মোঃ আঃ রহিম। এসএসসির প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় ইংরেজি প্রথম পত্রে ১৯%, দ্বিতীয় পত্রে ২২% পাওয়া ছাত্রী সুফিয়া বেগম দিলুকে পড়ানোর দায়িত্ব পায় সে। ২৮ জুলাই ১৯৯০ হতে ৭ মাস পড়ানোর পর এ ছাত্রী ১৯৯১ সালের এসএসসিতে ইংরেজি প্রথমপত্রে ৫৪% এবং ২য় পত্রে ৭২% নম্বর পায়। প্রি-টেস্টে ২০০ নম্বরের মধ্যে ৪১ (২০.৫০%) নম্বর পাওয়া ছাত্রী এসএসসিতে তিনগুণের চেয়েও তিন নম্বর বেশি অর্থাৎ ১২৬ নম্বর পায়। এরপর থেকে আর টিউশনি খুঁ জতে হয়নি তাকে। শুরুতে এ বাসা হতে মাসে ৫০০ টাকা পেলেও তিন মাস পর ৭০০ টাকা এবং পরবর্তীতে দিলু ও মাসুম দু’ভাই-বোনকে পড়ানোর বিনিময়ে মাসে ১৪০০ টাকা পায়। এ ছাত্র-ছাত্রীর পিতামাতা জনাব শরীফ-মিনু দম্পত্তি। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ায় অগ্রগতি হওয়ায় এ দম্পত্তি তাকে সন্তানের মতো আদর-স্নেহ করতেন।

শরীফ-মিনু দম্পত্তি অত্যন্ত আন্তরিক ও অভিভাবক প্রবণ মানুষ। তারা নিজের সন্তানের মতো আদর-স্নেহ করে প্রতিদিন পড়ানোর মাঝে তাকে ভালো নাস্তা দেয়। সে তাদের দু’সন্তানকে আলাদা আলাদাভাবে দু’ঘন্টা করে চার ঘন্টা পড়ায়। প্রি-টেস্টে ২০০ নম্বরের মধ্যে ৪১ নম্বর পাওয়া ছাত্রী এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় ইংরেজিতে ৪৩+৪৮=৯১ (৪০.৫০%) এবং এসএসসিতে ১২৬ (৬৩%) নম্বর পায়। ছাত্রী সুফিয়াকে সে এইচএসসিতেও ইংরেজি পড়ায়। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে। পরবর্তীতে উত্তরা উইমেন্স মেডিকেল কলেজে লেখাপড়া করে। অপর ছাত্র মাসুম বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। দিলু-মাসুম লেখাপড়ায় ভালো ফলাফল করায় তাদের ছোট মামা মোফাজ্জল হোসেন বাবু ও মামাতো ভাই মিজানকে পড়ানোর দায়িত্ব পায় সে। তারাও ভালো রেজাল্ট করে। এ কারণে তাকে কখনোই টিউশনি পাওয়ার চিন্তা করতে হয়নি। বরং নিজের টিউশনি বন্ধুদেরকে হস্তান্তর করে সহযোগিতা করতে পেরেছে। এভাবে কেউ টিউশনি ঠিক করে দিয়ে, কেউ টিউশনির টাকা যথাসময়ে প্রদান করে যথারীতি লেখাপড়া চালিয়ে নিতে সহযোগিতা করেছে। প্রতিটি পরিবার তার পাশে পিতামাতার ভূমিকায় থেকেছে। সে সর্বদা ভেবেছে, “আমার পিতা অভাবের তাড়নায় টাকা দিতে পারেনি। টিউশনির সুবাদে ছাত্র-ছাত্রীর মা-বাবা তাদের সন্তানদের পড়িয়ে নিয়েছে। তারা তাদের সন্তানদের পড়ানোর বিনিময়ে প্রতিনিয়ত অর্থ দিচ্ছে। অতএব, ছাত্র-ছাত্রীর মা-বাবা তারও মা-বাবা।” এভাবে ছাত্র-ছাত্রী বা টিউশনি যোগাড় করে দিয়ে, টিউশনির বিনিময়ে প্রতিনিয়ত অর্থ দাতা মাতা-পিতার ন্যায় ভূমিকা নিয়ে তারা সকলে তার পাশে দাঁড়িয়েছে এবং তার বেড়েউঠার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই ভূমিকা রেখেছে। এঁরা প্রত্যেকেই তার জীবন-যুদ্ধের সহায়ক শক্তি। তারা প্রত্যেকেই জীবন-যুদ্ধের পেলা, জীবনকে এগিয়ে নেয়ার অনুপ্রেরণা। 

এসব টিউশনির বাসা থেকে সে শুধু টাকা পয়সাই পায়নি বরং প্রতিটি পরিবারের ব্যবস্থাপনা কৌশল দেখেছে। অনেক পিতা-মাতাকে সে কাছ থেকে দেখেছে। পিতা-মাতার সাথে সুসম্পর্ক থাকলে সন্তান কত সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হয় তা সে স্বচক্ষে দেখে দেখে পরিবার গঠন ও পরিবার পরিচালনার শিক্ষাও সে নিয়েছে। তার এ দেখা থেকে শেখা পরবর্তী জীবনে নিজ পরিবার গঠন এবং প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা সফলভাবে পরিচালনা করতে শিখিয়েছে। এ টিউশনির কারণেই গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় বেড়ে উঠা জীবনের বাইরে এসে সে শহুরে জীবনধারা শিখেছে। শহুরে সংস্কৃতি দেখেছে, শহুরে সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়েছে এবং ধীরে ধীরে শহুরে হয়েছে। টিউশনির কারণে তার এ শিক্ষা অর্জন টিউশনির টাকার চেয়ে অনেক অনেক দামী। এ শিক্ষা অনেক বড় কিছু পাওয়া। এ টিউশনিই তাকে অংক, ইংরেজি নতুনভাবে শিখিয়ে বর্তমান চাকরি পেতেও বড় ভূমিকা রেখেছে। জীবনের পথ পরিক্রমায় সব জায়গা থেকেই আমরা শিক্ষা পাই। জীবনে সব জায়গা থেকেই শিক্ষা পাওয়া যায়। এভাবে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা সব জায়গাতেই ঋণী হয়ে থাকি। মাসিক জনপ্রশাসন পত্রিকার সাংবাদিক জনাব তুহিন এর ভাষায়, “শেখার জন্য সবাই শিক্ষক।” কবি সুনির্মল বসুর সবার আমি ছাত্র কবিতার ভাষায়-
“বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র।
নানানভাবে নানান জিনিস শিখছি দিবারাত্র।”

আট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস লাইফে (১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ সালে) প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে দুটি টিউশনি সেরে রাত ৮টায় ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে রাত ১০ টায় ঢাকার উপকন্ঠে সাভার উপজেলার পশ্চিম পার্শ্বস্থ সিংগাইর উপজেলার জায়গীর নামক গ্রামের বাড়িতে যায়। সাভারের হেমায়েতপুর হতে মাত্র ৭ কিঃ মিঃ পশ্চিমে রাস্তার উপর তাদের বাড়ি। শুক্রবার সারাদিন ভাইদেরকে পড়ায় এবং দিন শেষে ঢাকায় ফিরে আসে। ড. কালী প্রসন্ন দাস স্যারের সহযোগিতায় এবং নিজ উদ্যোগে ও নিজ হাতে গড়া (স্থাপিত ০৭ জুলাই ১৯৮৯) জায়গীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খবরও নেয়। স্কুলটি তখন শুক্রবার খোলা এবং শনিবার বন্ধ থাকত। এভাবে তার তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠে আদরের ভাইয়েরা, বেড়ে উঠে জায়গীর স্কুলের ছেলে-মেয়েরা। জুলাই ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলে প্রতিষ্ঠাকালীন ২ জন শিক্ষকের একজন মোঃ আঃ রহিম। অপরজন একই গ্রামের আব্দুল মালেক মোল্লা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হওয়া অবধি এ বিদ্যালয়ে মোট ১১ মাস শিক্ষকতা করে সে।

এ বিদ্যালয়ের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসের শিক্ষক সে। তার প্রথম দিনের ছাত্রদের মধ্যে ৯ জন এম এ পাশ করেছে। এদের একজন তার সহোদর ভাই মোঃ আব্দুল মাজেদ। পেশায় সে আজ ডাক্তার (বিসিএস হেল্থ) এবং অপরজন একই গ্রামের মোঃ মোশারফ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণীতে এমএসসি পাশ করেছে। প্রথম ব্যাচের ছাত্রী কামরুন্নাহার ও গুলশানারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র যারা লেখাপড়া শেষ করেছে তারা হলেন মোঃ আবদুল মান্নান শেখ, মোঃ শাহিনুর রহমান, মোঃ ইবারত হোসেন মোল্লা ও মহিউদ্দিন মোল্লা। এ বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র যিনি দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত প্রথম স্থান অর্জন করতো সেই জামাল উদ্দিন শেখ দারিদ্র্য ও পরিবারের ভুল সিদ্ধান্তে লেখাপড়া করতে পারেনি। সে এসএসসিও পাশ করতে পারেনি। এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব আহ্মাদ উল্লাহ্ মোল্লাহ্ তৎকালীন স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক জয়মন্টপ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৭২-১৯৯৭)।

নিয়মিত টিউশনি আর বাড়িতে ভাইদের লেখাপড়ার খোঁজখবর নেয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে এমএসসি ডিগ্রী সম্পন্ন করে সে। ১৯৯৭ সাল হয়ে উঠে পরিবারের জন্য প্রাপ্তির বছর। নিজের প্রথম শ্রেণীতে এমএসসি অর্জন এবং সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভূগোল বিভাগে শিক্ষকতা শুরু। সেজো ভাই শেখ মোহাম্মাদ আব্দুল মতিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, ৪র্থ ভাই আব্দুল বাতেনের এসএসসিতে স্টার মার্কস অর্জন ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ ভর্তি, ৫ম ভাই মোঃ আব্দুল মাজেদের পাবনা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি এবং মেজো ভাই আব্দুল করিম শেখের গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি।

নয়
১৯৯০ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারে জনাব মোঃ ইয়াছিন একাই আয় রোজগার করেন। ১৯৮৫ সালে বড় সন্তান নবম শ্রেণীতে, মেজো ও সেজো সন্তান তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। এ বছরই জনাব ইয়াছিনের কনিষ্ঠ পুত্র সোহানুর রহমানের জন্ম হয়। তার একার আয়ে ৯ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের ভরণ পোষণ চলে। একজনের আয়ে এতগুলো মানুষের গায়ের পোষাক, তিন বেলা খাবার, ঘরের ছাউনী কোনটিই সঠিকভাবে দেয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণেই ঘরে ছাউনী নেই, গায়ে ভালো পোশাক নেই, তিন বেলা পেটপুরে খাবার নেই। দারিদ্র্যের এ চরম আঘাতের মাঝেও তিনি সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ করেননি। মেজো পুত্র আবদুল করিম শেখ বাবার সাথে কৃষাণী করে দু’জনে মিলে এক ভাগ ধান পায়। এ ধানের চালের ভাত খেয়ে বড় পুত্রসহ অন্য পুত্ররা লেখাপড়া করেছে। বাবার সাথে কাজ করে পরিবার পরিজনের ভরণ-পোষণের দায়িত্বের ভাগ নেয়ায় সে লেখাপড়ায় কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। আবার বড় পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে টিউশনির আয়ে সকলের লেখাপড়া পূর্ণোদ্যমে চালু করে। এভাবেই তারা পথ চলে। এভাবেই তারা বেড়ে উঠে।

জনাব মোঃ ইয়াছিন কাল‣বৈশাখীর ঝড়ের দিনে ঝড়ের তীব্র তান্ডবের মধ্যে ডান হাতে দা, বাম হাতে বাঁশের খুঁটি আর কাঁধে ঝুলানো রশি নিয়ে ঘরের এখানে ওখানে বাঁশের খুটির পেলা, ঠেলা বা ঠেকনা বা ঠেস দিয়েছে যাতে ঝড়ের আঘাতে ঘরটি ভেঙ্গে না পড়ে। আর জোরে জোরে চিৎকার করে উচ্চারণ করেছে “লাইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ্ জোয়ালেমীন।” প্রতিবার বিদ্যুৎ চমকানোর আলো ও আওয়াজের সময় সে এ দোয়া পড়েছে। ঝড়ের তীব্রতা, শিলাবৃষ্টির আঘাত, ঠাটা বা বাজ পড়ে মৃত্যুর ভয় তাকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। কারণ ঘরের মধ্যে যে তার ৮টি প্রিয়জন। মা, স্ত্রী ও ৬ সন্তান। ঝড়ের তীব্রতা আর বজ্রপাতের আওয়াজের সময় তার পেলা বা ঠেস লাগানো আর তীব্র আওয়াজে কালেমার উচ্চারণ ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেয়া শিশু সন্তানদের কাছে মনে হয়েছে যে, বাবার কালেমা পড়ার কারণে আল্লাহ কাছে চলে এসেছে। অতএব, এখন আর তাদের কোন ভয় নাই। কবি সুকান্তের ‘ডাক হরকরা’ কবিতায় ডাক বহনকারী রানার রাতের অন্ধকারে এক হাতে লণ্ঠন, এক হাতে বল্লম আর কাঁধে চিঠিভরা ডাকের ঝুলি নিয়ে সূর্যোদয়ের পূর্বেই গন্তব্যে পেঁ․ছায়। বন-জঙ্গলের হিংস্র জন্তু কিংবা
ডাকাতের ভয় তাকে থামাতে পারেনি। সুকান্তের ভাষায়, “ তার চেয়েও ভয়, তার চেয়েও ভয় কখন সূর্য উঠে !”

দায়িত্বের প্রতি অবিচল জনাব ইয়াছিন তার পরিবার-পরিজন এবং কর্মস্থলে সহকর্মীদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা এমনই এক অকুতোভয় রানার। ইয়াছিন বাঁশের পেলা, ঠেক, ঠেস বা ঠেলা দিয়ে ঝড়ের কবল থেকে ঘরটিকে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছে। ঘর কখনো ভেঙ্গে পড়েনি। তার প্রিয়জন কখনো ব্যথা পায়নি। ইয়াছিন নিজে খেটেছে, কষ্ট করেছে, কোমরে তীব্র ব্যথা নিয়ে মাটি কেটেছে। সবটুকু সততা রক্ষা করে মা, স্ত্রী ও সন্তানদের খাইয়েছে। সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছে আর সৃষ্টার দরবারে দোয়া করেছে,“ হে আল্লাহ! আমার জীবনে যে কষ্ট হয়েছে, আমার সন্তানদের জীবনে যেন সে কষ্ট না হয়।” আজ ইয়াছিনের হাতে কাল‣বৈশাখীর ঝড়ের দিনে বাঁশের খুঁটি নেই। আজ সে রোদে পুড়েনা, বৃষ্টিতে ভিজেনা। ১৯৯০ সালের ন্যায় কাল‣বৈশাখীর দিনে ঝড়ো হাওয়ায় বাইরে থাকেনা। ছাউনীবিহীন আর ফোটায় ফোটায় বৃষ্টিঝরা ঘরে পেলা দিতে হয়না। আজ তাঁর পাশে ৬টি পেলা। তাঁর ৬ সন্তান প্রত্যেকেই লেখাপড়া করেছে, মানুষ হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক পুত্র ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, দুই পুত্র বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, এক পুত্র বিসিএস পাস করা ডাক্তার, একপুত্র ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপক। আরেক পুত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে মেটলাইফ এলিকোর এজেন্সী ম্যানেজার।

ঝড়ের দিনেও বাঁশের পেলায় ঘর নিরাপদ রেখে বড় করে তুলেছেন ইয়াছিন তার সন্তানদের। তার সন্তানেরা আজ সমাজের পেলা, তার নিজের জন্য পেলা, দেশের জন্য পেলা। এভাবেই বেড়ে উঠে ইয়াছিনের পরিবার। এভাবেই বেড়ে উঠতে হয় ইয়াছিনদের। কাল‣বৈশাখীর দিনে বাঁশের খুঁটি ছিল ঘর বাঁচানোর পেলা। আজ তার সন্তানের জীবনে শিক্ষানামক এক শক্তি এসেছে জীবন গড়া ও সমৃদ্ধির পেলারূপে। চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিষ্পেষিত হলেও শিক্ষা নামক পেলার বলে, শিক্ষার পেলায় ভর করে আজ তাদের নতুন জীবনধারা। আজ বাড়িতে ছাউনীবিহীন ভাঙ্গা ছনের ঘর নেই। কাল‣বৈশাখীর তীব্র ঝড় ও শিলাবৃষ্টির কাছে হার না মেনে অকুতোভয় সৈনিকের মতো বাঁশের পেলায় ঘর বাঁচিয়েছে ইয়াছিন। জীবন বাজী রেখে শরীরের সবটুকু শক্তি খাটিয়ে, প্রতিনিয়ত শরীরের ঘাম ঝরিয়ে এবং রক্ত পানি করা আয় দিয়ে সততার সর্বোচ্চ নিদর্শণ নিশ্চিত করে সন্তানদের মানুষ করেছে এবং সমাজের জন্য ও দেশের জন্য পেলা বানিয়েছে। কাল-বৈশাখীর ঝড়ের দিনে জনাব ইয়াছিন বাঁশের পেলা দিয়ে ঘর বাঁচিয়েছে, তার আটজন প্রিয়জনকে নিরাপদ রেখেছে।

আজ তার পরিবারে শিক্ষা নামক নতুন পেলার আবির্ভাব হয়েছে। এ পেলায় ভর করলে কেউ আঘাত পায়না, দারিদ্র্যের চাপ ও চাপায় কেউ নিষ্পেষিত হয়না। বরং শিক্ষার পেলায় ভর করে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ছিন্ন করে, দারিদ্র্যের অভিশাপ ও কষাঘাত থেকে বেরিয়ে সমৃদ্ধির সোপান তৈরী করে। নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষায়, “ শিক্ষা এমন এক অস্ত্র যা দিয়ে তুমি সবকিছু জয় করতে পার, পৃথিবীকে বদলে দিতে পার।” তাই ঘরে ঘরে চাই ইয়াছিনের পেলা। ইয়াছিনের পেলা বয়ে আনুক সকলের জন্য সমৃদ্ধির ভেলা।

ইয়াছিন কাল‣বৈশাখীর দিনে বাঁশের পেলায় ঠেক দিয়ে ঘর বাঁচিয়েছে, পরিবার পরিজনকে ঝড়ের তান্ডবে ঘর চাপা পড়া থেকে রক্ষা করেছে। আসলে ইয়াছিন ও তার সন্তানেরা সারা জীবন সমাজ, রাষ্ট্র, আত্মীয়-স্বজন এবং শিক্ষা জীবন ও কর্মজীবনে অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে পেলার সুবিধা নিয়েছে, পেলার সুবিধা পেয়েছে। আচরণ ঠিক রেখে তারা তা সকলের কাছ থেকে নিতে পেরেছে। তার বড় সন্তান শুধুমাত্র বোর্ড ফি দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ নিয়েছে। এ বোর্ড ফি এর ৩০০ টাকা ধার দিয়েছেন নিজ গ্রামের বড় ভাই জনাব মোঃ আমজাদ হোসেন নান্নু মিয়া। জনাব নান্নু মিয়ার সহোদর এডভোকেট আফতাব হোসেন লেখার কাগজ কেনার জন্য মাসে ৪০ টাকা করে দিয়েছেন ১৯৮৬ সালে দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায়। গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক জনাব মোঃ নাসির উদ্দিন ১৯৮৭ সালে দুটি প্রতিষ্ঠান হতে ১০০০ টাকার দুটি স্কলারশীপ সংগ্রহ করে দিয়েছেন। জনাব মোঃ নাসির উদ্দিন এসএসসি পাসের পর উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, “বাড়ির বাইরে গিয়ে লেখাপড়া কর। এতে সম্মান ও সমৃদ্ধি দুটোই আসবে।”

পুরো হাইস্কুল জীবন অর্ধ বেতনে পড়েছে সে। জয়মন্টপ উচ্চ বিদ্যালয় মাসিক ৮ টাকার স্থলে ৪ টাকা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। জনাব ইয়াছিনের বাকী ৫ পুত্রও এ বিদ্যালয় থেকে হাফ ফ্রি-র সুবিধা নিয়েছে। সাভার কলেজের প্রিন্সিপাল দীপক রায় স্যার ৭০০ টাকার স্থলে ৪০০ টাকায় ভর্তির অনুমতি দিয়ে এইচএসসিতে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই ৪০০ টাকার মধ্যে ২০০ টাকা তার পাশের বাড়ির চাচা বিএসসি
শিক্ষক জনাব মোঃ শরবেশ আলী দিয়েছেন। এ দিনে চাচা জনাব মোঃ শরবেশ আলী (সিনিয়র শিক্ষক, ইউনিয়ন কাউন্সিল উচ্চ বিদ্যালয়, ধল্লা, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ) তাকে ২০০ টাকার বইও কিনে দিয়েছেন। নিজ গ্রামের বড় ভাই জনাব মোঃ আকমল হোসেন (পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক, জায়গীর প্রাথমিক বিদ্যালয়) ভালো সাবজেক্ট নিয়ে লেখাপড়া করে ভালো রেজাল্ট করার লক্ষ্যে সাভার কলেজে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছে এবং ভর্তির সময় সাথেও থেকেছে। জনাব মোঃ আকমল হোসেন তাকে এসএসসি লেভেলে বিনা পয়সায় এক বছর বুককিপিং পড়িয়েছেন।

সাভার কলেজ কর্তৃপক্ষ বোর্ড স্কলাশীপের সুবাদে ২ বছর বিনা বেতনে পড়িয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার সময় বোর্ড ফি যোগাড় করতে না পারায় পার্শ্ববর্তী খাসেরচর গ্রামের সহপাঠী জনাব মোঃ নুরুল ইসলামের অনুরোধে সাভার কলেজ কর্তৃপক্ষ বোর্ড ফি ছাড়াই এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। সাভার কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে তার বোর্ড ফি পরিশোধ করেছে। সাভার কলেজ কর্তৃপক্ষ এ পরিবারের জন্য পেলা। কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবরে সহপাঠী জনাব মোঃ নূরুল ইসলামের বক্তব্য,“স্যার, আঃ রহিমের বোর্ড ফি দেবার সামর্থ্য নাই। অনুগ্রহপূর্বক কলেজের ফান্ড থেকে বোর্ড ফি পরিশোধ করার ব্যবস্থা নিন। আঃ রহিম ফার্স্ট ডিভিশন পাবে এবং কলেজের জন্য একটি ফার্স্ট ডিভিশন বাড়িয়ে দেবে।” ১৯৮৭ সালের এসএসসির ফলাফলে আঃ রহিম সিংগাইর উপজেলায় প্রথম হয়েছে এবং এই নূরুল ইসলাম প্রথম বিভাগ পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে। সাভার কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষের ফলাফলে নুরুল ইসলাম প্রথম হয়েছে এবং আঃ রহিম দ্বিতীয় হয়েছে। জনাব মোঃ নুরুল ইসলাম পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে র‌্যাংগ্স গ্রুপের লিগ্যাল হেড ও মহাব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

দশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় অর্থাভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে তার কলেজ শিক্ষক ড. কালী প্রসন্ন দাস পেলা হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি সাহস যুগিয়ে বলেছেন, “আঃ রহিম, তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হও। আমি তোমাকে টিউশনি ঠিক করে দেব। তুমি টিউশনির টাকায় চলতে পারবে।” ড. কালী প্রসন্ন দাস স্যার টিউশনি ঠিক করে দেবেন। টিউশনি থেকে টাকা পাওয়া যাবে এবং টিউশনির টাকায় লেখাপড়ার খরচ চালাবে, এ আশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। ঢাবিতে ভর্তির ২ বছর পর ড. কালী প্রসন্ন দাস স্যার টিউশনি ঠিক করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে বিকল্প সহায়তায় ভাবি কুলসুম ইসলামের বাসায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।

ঢাবিতে ভর্তির সময় কালী প্রসন্ন স্যারের পক্ষ থেকে টিউশনির এ আশাটুকু দেখানো অতীব জরুরী ছিল। এ আশার উপর ভর করেই তার ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি। ডেল কার্ণেগীর ভাষায়, “ আজকের দিনের জন্য তো বাঁচ।” দ্বিধাগ্রস্ত জীবনে বিজ্ঞজনের ধৈর্য্য শিক্ষা ÒA day is not a life time.” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর এবং ক্লাস শুরু হওয়ার ৪ দিন আগে নিজ গ্রামের মাতৃসম ভাবি কুলসুম ইসলাম, ৫৩ বনগ্রাম রোড, ওয়ারী ঢাকা কে ১২/০৬/১৯৯০ তারিখে বিনয়ের সাথে সে বলেছে, “ভাবি, থাকারও জায়গা নেই, খাওয়ারও টাকা নেই, ১৬ জুন, ১৯৯০ তারিখে ক্লাস শুরু। কী করব?” ভাবি তাকে মায়াভরা কন্ঠে মায়ের মত দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, “আমি যা খাই, তুমি তাই খাবে। তুমি আমার বাসায় চলে এসো। তোমার জন্য তো আমাকে আলাদা রান্না করতে হবেনা।” তার এই মায়াভরা কন্ঠে ১৫ জুন ১৯৯০ তারিখ থেকে এ বাসায় থাকা খাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এ বাসায় ১১ মাস অবস্থান করে, বিনা পয়সায় থাকা খাওয়ার সুবিধা নিয়ে ২/৩টি টিউশনি যোগাড় করে, টিউশনির টাকায় স্বাবলম্বী হয়ে ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিজ হল শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ২০১৫ নং কক্ষে চলে আসে।

এই কুলসুম ইসলাম ভাবি তার জীবনে মায়াবী মা ও গ্রানাইট শিলাসম মজবুত স্তম্ভরূপে সারাজীবন তার পাশে থেকেছে এবং অবিচল ও দ্বিধাহীন আস্থা রেখেছে। এ ভাবির এতটাই আস্থা ছিল যে, তিনি মনে করতেন আঃ রহিম কখনও অন্যায় করতে পারেনা। তাইতো ১৯৯৮ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর রূপালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে যোগদান করে, প্রথম দিন অফিস শেষে তার বাসায় গিয়ে দেখা করার সময় এই ভাবি অঝোরে কেঁদেছেন আর বলেছেন, “আল্লাহ তোমাকে চাকরি দিবেনা তো কাকে দিবে? তুমি তো তোমার মা-বাবা ভাইবোনকে ভুলোনি।” তিনি তার এ বাক্যের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, মা-বাবা, ভাই-বোনকে ভুলে যাওয়া যাবেনা। মাতৃসম এই ভাবির স্বামী প্রকৌশলী মোঃ নূরুল ইসলাম, দুই পুত্র সাইফুল ইসলাম ও মনিরুল ইসলাম এবং দুই কন্যা রুনু ও নাহার বর্তমানে USA তে বসবাস করছেন। তিনি ২২শে ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে USA তে মিনোসোটা নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দেড়মাস আগে একটানা প্রায় দেড় ঘন্টা কথার ফাঁকে জানিয়ে যান, “জান আঃ রহিম, আমি তোমাকে কখন থেকে খেয়াল করেছি? তোমার এসএসসি পরীক্ষার আগে আমি তোমার পাশের বাড়ির মজিবর কাকাদের বাড়িতে গিয়েছি। তুমি মজিবর কাকার বাবার রুমে থেকে পড়তে। আমি ১৯৮৬ সালের ঐ দিনটিতে জেনেছি যে, তোমার বাড়িতে থাকার ঘর নাই, তাই তুমি তাদের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া কর। আমি সেদিন থেকেই তোমাকে খেয়ালে রেখেছি।”

এই মাতৃসম ভাবির বোন খুকি আপা ১৯৯১ সালে রামপুরা ও মালিবাগ রেলগেট এলাকায় টিউশনি ঠিক করে দিয়েছেন। ডিসেম্বরের কনকনে শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখে শীতের পোষাকও দিয়েছেন। চারপাশের সকলেই এ পরিবারের জীবন যুদ্ধের মাঠে সহযোগী পেলা। তারা সকলেই তাদেরকে জীবনে হেলে পড়া থেকে এবং জীবনে হারিয়ে যাওয়া থেকে সহযোগীতানামক পেলা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। জীবনে কত পেলা লাগে! কত পেলার যোগফলে একটি সুন্দর জীবন ও একটি প্রতিষ্ঠিত জীবন গড়ে উঠে! ঠিক যেন প্রবাদ বাক্যের মত,
“পাখি শুধু নিজের পাখায় ভর করে উড়তে পারেনা।
এক শালিকের ডাকাডাকিতে গ্রীষ্ম আসেনা।”

জীবনে কত চেষ্টা লাগে! জীবনে কতজনের কত সহযোগিতা লাগে! কত শত পেলায় ভর করে গড়ে উঠে একটি প্রতিষ্ঠিত জীবন! কবি যথার্থই বলেছেন,
“ তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী।
কিন্তু মানুষ, শত চেষ্টায় তবে মানুষ।”

শুধুই কী নিজের চেষ্টা? কখনও পেলা, কখনও টিউশনি নামক আশার ভেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর টিউশনি পাবে, টিউশনি থেকে টাকা পাবে এবং টিউশনির টাকায় লেখাপড়া করবে। কী দারুন আশার ভেলা! অধ্যাপক ড. কালী প্রসন্ন দাস স্যার, কী এক দারুন আশান্বিত করার পেলা! জীবন যুদ্ধে প্রতিটি মানুষ যাতে ভয়ে ভিত ও বিচলিত না হয়ে ক্রমাগতভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য সাহস রাখে এবং সাহসিকতার সাথে ক্রমশ সম্মুখে এগিয়ে যায় সম্ভবত একারণেই কবি লিখেছেন,
“সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা
আশা তার একমাত্র ভেলা।”

আশা নামক ভেলায় আস্থা রেখে নিরন্তর কাজ করলে অসংখ্য পেলা পাশে আসে। অসংখ্য পেলা পাশে দাঁড়ায়। গড়ে উঠে সুন্দর জীবন। অনেকেই পাশে দাঁড়িয়ে জীবনকে দাঁড় করিয়ে দেয়। এখন প্রতিদিন জীবন দেখি। প্রতিনিয়ত জীবন থেকে শিখি। হয়তো আরও দেখব, আরও শিখব। আরও অনেক পেলায় ভর করে, অনেক পেলায় ভর দিয়ে হয়তো একদিন আরও বড় হব। অনেকেই বড় হয় অনেক পেলায় ভর করে। আগামীতেও অনেকেই বড় হবে।

এভাবে দারিদ্র্যক্লিষ্ট সংসার সাগরে অনাগত দিনে অগণিত মানুষ বড় হবে,
“আশা নামক ভেলায় চরে
আশা নামক ভেলায় সওয়ার হয়ে
আশা নামক ভেলায় আস্থা রেখে
অগণিত আশার পেলায় ভর করে।”

লেখক” উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড।

এএ

মোঃ আঃ রহিম

আরও পড়ুন