ব্যাংকার প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০:০৬, ২২ জুন ২০২৫ | আপডেট: ২০:০৬, ২২ জুন ২০২৫
বাংলাদেশে আর্থিক খাতের প্রসার ও পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গোটা জাতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বে আর্থিক বিপর্যয়ের সংক্রমণ বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ সংক্রমণ এমন একটি অবস্থা যেখানে একটি বৃহৎ ব্যাংকের সমস্যা অন্যান্য ব্যাংককে আক্রান্ত করে। সামগ্রিক আর্থিক খাতের একটি অংশের সমস্যা যখন গোটা আর্থিক খাতকে সংক্রমিত করে তখন সেটিকে আর্থিক বিপর্যয়ের সংক্রমণ বলা যায়।
বাংলাদেশে এ ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ের সংক্রমণ ঘটেনি। তবে, বিশ্বমন্দা-উত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সজাগ থাকার আবশ্যকতা আছে। বস্তুতপক্ষে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সমন্বিত সুপারভিশনের গুরুত্ব অপরিসীম।
বিশ্বমন্দার অভিজ্ঞতাও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ‘ম্যাক্রো প্রুডেনশিয়াল’ কাঠামোকে সঠিক অবস্থানে রাখার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা কাঠামোকে শক্তিশালীকরণ, সঞ্চিতি কাঠামো পুনর্নির্ধারণ, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া ও মডেল শক্তিশালীকরণ, ‘সিস্টেমিক ঝুঁকি’ পূর্বানুমান করতে ‘স্ট্রেস টেস্টিং’ কৌশল প্রবর্তন, তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি সুপারভিশন কাঠামো শক্তিশালীকরণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত সর্বোত্তম ব্যবস্থাগুলোর আলোকে নীতিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং আইনগত বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ এর ৭ (এ) ধারায় দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যাদি তত্ত্ববধান করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর ন্যস্ত করা হয়। ব্যাংকিং খাতে সার্বিক স্থিতিশীলতা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের পাশাপাশি আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক দু’ধরনের সুপারভিশন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এর একটি হলো অফ-সাইট সুপারভিশন বা বিবরণীভিত্তিক তত্ত্বাবধান, অপরটি হচ্ছে অন-সাইট সুপারভিশন বা সরেজমিন তত্ত্ববধান।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাঠানো রিপোর্ট বা আর্থিক বিবরণীর উপর ভিত্তি করে ক্যামেলস্ রেটিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সামর্থ্য নির্ণয়ের পাশাপাশি সমস্যায় আক্রান্ত এবং নিবিড় তদারকির প্রয়োজন এরূপ ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে অফ-সাইট সুপারভিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অফ-সাইট সুপারভিশনে ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন সূচকের অবনমন ও উন্নতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। অফ-সাইট সুপারভিশনে প্রাপ্ত অনিয়মের বিষয়ে সময়ে সময়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করে অনিয়মগুলো নিয়মিতকরণের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকে।
তাছাড়া, ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও অডিট কমিটির সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে তা নিয়মিতকরণের জন্য তাদেরকে পত্র দেওয়া হয়। অপরদিকে, অন-সাইট সুপারভিশনের মাধ্যমে সরেজমিনে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়। ব্যাংকের সামগ্রিক অবস্থা মূল্যায়নের জন্য বার্ষিক বিশদ পরিদর্শন কর্মসূচির আওতায় প্রত্যেক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ কিছু বড় শাখা (যে শাখাগুলো ব্যাংকের মোট ঋণের ৭০-৮০ শতাংশ আবৃত করে) প্রতি বছর পরিদর্শন করা হয়। অবশিষ্ট শাখাগুলো ছোট শাখা হিসেবে প্রতি তিন/চার বছর অন্তর পরিদর্শন করা হয়।
ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণমান বিশেষ করে, ঋণ ও অগ্রিমের গুণমান যাচাই করাই বিশদ পরিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য। এ ছাড়া, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হয় এমন শাখাগুলোতে বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থায়ন ও ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি কার্যক্রম এবং মানিলন্ডারিং বিষয়ে বিশদ পরিদর্শন করা হয়ে থাকে। মানি চেঞ্জারগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সংক্রান্ত পরিদর্শনও পরিচালনা করা হয়। ব্যাংকগুলোর কোর রিস্ক যেমন সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা (এএলএম), ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (সিআরএম), বৈদেশিক বিনিময় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (এফইআরএম), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (এএমএলআরএম), অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালন (আইসিসি), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পদ্ধতিগত পরিদর্শন পরিচালনা করে।
গ্রাহক, আমানতকারী, জনসাধারণ বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে অথবা বিশেষ প্রয়োজনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করা হয়। বিশেষ পরিদর্শনে ব্যাংকগুলোর জাল-জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাতের মতো গুরুতর অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয়।
আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করার মাধ্যমে আর্থিক খাতে অধিকতর স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ হতে সুনিদিষ্ট উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ক্রমপরির্বতনশীল ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন প্রণয়ন ও সংস্কার করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতের নজরদারির বিদ্যমান সুপারভিশন পদ্ধতিতেও কৌশলগত পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। ঝুঁকিকে মুখ্য বিবেচনায় নিয়ে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অবস্থা নিরন্তর তদারকি শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাসহ ব্যাংকের সামগ্রিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন, আয়-ব্যয় ইত্যাদিসহ আর্থিক, পদ্ধতিগত এবং প্রশাসনিক নীতি-নির্ধারণী ও নির্বাহী কার্যক্রমে পরিচালনা পর্ষদ, পর্ষদের চেয়ারম্যান ও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর দায়-দায়িত্ব, জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
ব্যাংকের নানামুখী কর্মকাণ্ডে জড়িত বিভিন্ন ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ, মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইনগুলো অনুসরণের জন্য বিভিন্ন সময়ে দেওয়া নির্দেশনা ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে পালন করছে কি না তা তদারকিতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস
এএ
ব্যাংকার প্রতিবেদন